মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে যেন এক বিস্ফোরক মোড় নিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর এক বিতর্কিত দাবি ঘিরেই যেন শুরু এই নতুন দ্বন্দ্বের অধ্যায়। বছর শুরুর দিকে সংস্থাটি জানায়, ইরানের হাতে ছয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো উপকরণ মজুদ রয়েছে। মুহূর্তেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্কের স্রোত। কেউ কেউ এটিকে ইরানের সাফল্য হিসেবে দেখলেও, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চোখে এটি এক অশনি সংকেত।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র যেন তার পুরোনো কৌশলে ফিরে গিয়েছে—ইরানকে কোণঠাসা করা, নানা ধরনের রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ এবং যুদ্ধের হুমকি। তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ইস্যু করে নতুন করে আলোড়ন তুলতে ব্যস্ত মার্কিন প্রশাসন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, IAEA-এর এমন একতরফা বক্তব্যের পিছনেও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চক্রান্ত।
তবে পরিস্থিতি মোড় নেয় তখনই, যখন IAEA প্রধান রাফায়েল গ্রসি স্পষ্ট ভাষায় জানান—ইরানের কাছে বর্তমানে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নেই। যদিও তিনি সতর্ক করে দেন, ইরানের হাতে রয়েছে এমন সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, যা দিয়ে ছয় থেকে সাতটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব। এই মিশ্র বার্তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নতুন করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
ইরান একাধিকবার বলেছে, তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম একান্তই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি আবারও আশ্বস্ত করেছেন যে, ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চোখে এটি এক ভিন্ন বাস্তবতা। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিকবার হুমকি দিয়েছেন, তেহরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের শর্তে কোনো চুক্তিতে না আসে, তবে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানো হবে।
এই অবস্থায় ইরানও নিয়েছে রণকৌশল। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র যদি তার মিত্রদের ভূমি বা আকাশপথ ব্যবহার করে হামলা চালায়, তাহলে তা শত্রুতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে একাধিক দেশের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে তেহরান। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শহরগুলো, লোড করা হয়েছে ব্যালিস্টিক মিসাইল।
অন্যদিকে, এই উত্তেজনার আবহে রাশিয়া মধ্যস্থতাকারী হিসেবে শান্তিপূর্ণ সমাধানে এগিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হলো কূটনৈতিক আলোচনা। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, যখন যুদ্ধের আয়োজনই গড়ে উঠছে এক অস্তিত্বহীন পারমাণবিক অস্ত্রকে কেন্দ্র করে, তখন এই গোটা নাটকটির পেছনে কী যুক্তরাষ্ট্র ও IAEA-এর এক কৌশলগত প্রহসন নয়?
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখন একটি কৌশলগত চাপে ফেলতে চাচ্ছে ইরানকে। সরাসরি যুদ্ধ নয়, বরং তথ্যযুদ্ধ, রাজনৈতিক অপপ্রচার এবং কূটনৈতিক হুমকির মাধ্যমে ইরানকে বিশ্বমঞ্চে হেয় করা—এটাই আপাতত তাদের মূল লক্ষ্য। ইরানও সেই ফাঁদে পা না দিয়ে সময় নিচ্ছে, চালছে হিসেব-নিকেশ করে।
শেষ পর্যন্ত কি হবে— সংলাপ না সংঘাত? আপাতত বল রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে। কিন্তু একথা নিশ্চিত— মধ্যপ্রাচ্য এখন এক অস্থির বিস্ফোরকের উপর বসে আছে, যার সলতে যে কোনো সময় জ্বলে উঠতে পারে।