বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৮ মার্চ তার প্রথম চীন সফরের সময় ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন, তার রেশ এখন বেইজিং আর দিল্লি ছাড়িয়ে আছড়ে পড়েছে ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের মঞ্চেও।
ভারতের কোনো অংশই যে ‘স্থলবেষ্টিত’ নয়, তা বোঝাতে বিমসটেকের প্ল্যাটফর্ম থেকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) বলেছেন, বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে লম্বা উপকূলরেখা কিন্তু ভারতেরই।
এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরেও উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘অ্যাকসেসে’র পথ প্রশস্ত হতে চলেছে বলে তিনি দাবি করেছেন। জয়শঙ্করের এই মন্তব্য যে অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্যের পাল্টা জবাব দিতেই, তাতে কোনো সন্দেহই নেই।
ভারতের শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন, অধ্যাপক ইউনূসের ওই মন্তব্য কূটনৈতিক রীতিনীতির পরিপন্থি। ভারতের সঙ্গে যিনি সুসম্পর্ক চান তিনি কীভাবে এই কথাগুলো তৃতীয় একটি দেশে সফরে গিয়ে বলতে পারেন এটাও তাদের বোধগম্য হচ্ছে না।
কিন্তু অধ্যাপক ইউনূস যে কথাগুলো বলেছেন সেটা তথ্যগতভাবে ভুল নয়।
অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, ভারতের সেভেন সিস্টার্স ‘ল্যান্ডলকড’ বা স্থলবেষ্টিত একটি অঞ্চল এবং ওই অঞ্চলে ‘সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক’ বাংলাদেশ – চীন যেটাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারের কথা ভাবতে পারে।
দিল্লিতে সাউথ ব্লকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘একটা কথা ফ্যাকচুয়ালি কারেক্ট হলেই যে ডিপ্লোম্যাটিক্যালি কারেক্ট হবে, তার কোনো মানে নেই।’
অধ্যাপক ইউনূস যে কারণেই ওই মন্তব্য করে থাকুন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা যে তার একটা ‘সেমসাইড গোল’, তাতে আমাদের অন্তত কোনো সন্দেহ নেই।’
এদিকে গতকাল বুধবার ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার ‘হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ’ খলিলুর রহমান একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ড. ইউনূসের মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘কানেক্টিভিটি’ এই অঞ্চলে যে বিপুল সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিতে পারে, সেই পটভূমি থেকেই প্রধান উপদেষ্টা কথাগুলো বলেছেন এবং তার উদ্দেশ্যও ছিল সম্পূর্ণ সৎ।’
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বঙ্গোপসাগরীয় জোট বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলন বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে। সেখানেও এই মন্তব্যের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে দিল্লিতে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন।
তারা বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের মধ্যে সম্পর্কের বরফ ব্যাংককেই গলতে শুরু করবে এমন একটা সম্ভাবনা যে দেখা যাচ্ছিল – সেটা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠবে অবধারিতভাবে।
সব মিলিয়ে বেজিং-এর একটি অনুষ্ঠানে মাত্র ৩০ বা ৩২ সেকেন্ড ধরে বলা মুহাম্মদ ইউনূসের ওই কয়েকটি কথা যে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছে তাতে কোনো সংশয় নেই।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ভিনা সিক্রি বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নির্দিষ্ট বাণিজ্য রুট নিয়ে যাবতীয় ব্যাখ্যা সমেত সীমান্ত সমঝোতা অনেক আগে থেকেই আছে, আর আমি মনে করি সেটাকে মর্যাদা দেয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্ব যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতকে ল্যান্ডলকড বলছেন, তার লজিকটাই আমার মাথায় ঢুকছে না।’
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিব্বাল তার এক্স হ্যান্ডলে ড. ইউনূসের মন্তব্যের একটি ভিডিও পোস্ট করে লিখেছেন, ‘এটা আসলে একটা বিপজ্জনক ভাবনা!’
তিনি বলেন, এটা সেই প্রাক-হাসিনা যুগের রাজনৈতিক দর্শনে ফিরে যাওয়া, যে বাংলাদেশের তিনদিকে যদি ভারত ঘিরে থাকে আর তাদের ভালনারেবল করে তোলে, তাহলে বাংলাদেশও ভারতের নর্থইস্টকে তিনদিক থেকে ঘিরে আছে আর বাংলাদেশও সেটাকে একটা ‘পয়েন্ট অব প্রেশার’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে!’
চীন যাতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে গিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সে লক্ষ্যে তাদের প্ররোচিত করার একটি চেষ্টা হিসেবেও এটিকে দেখছেন কানওয়াল সিব্বাল।
ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, সেভেন সিস্টার্স যে ‘ল্যান্ডলকড’ – সে কথা উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস আসলে সরু ‘চিকেনস নেক’ বা শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমে বাকি ভারতের সঙ্গে যুক্ত উত্তরপূর্বাঞ্চলের ‘ভালনারেবিলিটি’র কথাই স্মরণ করাতে চেয়েছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা