ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বাহিনী ও সশস্ত্র হামাসের মধ্যে সংঘাত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর এটি ভয়াবহ রূপ নেয়। সেই দিন শনিবার ভোরে ইহুদি ধর্মীয় উৎসব চলাকালীন হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরায়েলের সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে রকেট হামলার পাশাপাশি এক অব্যর্থ ও বিস্ময়কর স্থল আক্রমণ চালান। এই হামলাটি ছিল নজিরবিহীন।
গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস-এর বন্দুকধারীরা ভূখণ্ডটির সীমান্তঘেঁষা প্রায় ২২টি স্থানে এবং সীমান্ত থেকে ২৪ কিলোমিটার ভেতরে ইসরায়েলি শহরগুলোতে আকস্মিক আক্রমণ চালান। এতে ইসরায়েলি নাগরিকসহ কমপক্ষে ২৫০ জন নিহত হন এবং ১,৫০০ জন আহত হন। এসময় নারী-শিশুসহ দুই শতাধিক নাগরিককে জিম্মি করে নিয়ে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা এবং সশস্ত্র বাহিনী দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হয়। তবে এই আক্রমণকে ন্যক্কারজনক হামলা উল্লেখ করে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী। হামাসের পাল্টা প্রতিরোধ এবং ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার ফলে সেই সংঘাত দ্রুতই সর্বনাশা যুদ্ধে রূপ নেয়। তবে সেই সংঘাতে হতাহত নিরপরাধ ফিলিস্তিনি নারী-শিশুসহ হামাস যোদ্ধাদের সংখ্যা দুঃখজনকভাবে বাড়তে থাকলেও হামাসের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলি বাহিনীতে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসতি গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। একই সময়ে প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। সেই ৭ অক্টোবর ভোরে হামাসের আক্রমণে প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। ওই হামলায় ২৫১ ইসরায়েলি অপহৃত হন, যাদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধবিরতির চলাকালীন মুক্তি পেলেও ৫৯ জন এখনও জিম্মি অবস্থায় রয়েছেন।
হামাসের সেই হামলার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে বসতি স্থাপনকারী ইহুদি জনগোষ্ঠীর সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়া এবং তা প্রতিহত করতে নেতানিয়াহুর কট্টর-ডানপন্থী জোট সরকারের ব্যর্থতা। এই নীতিগুলো হামাসের ক্ষোভ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার দাবি, নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার জনই হামাস যোদ্ধা।
এই সংঘাত কী মূলত ধর্মীয় যুদ্ধ, নাকি এটি ভূখণ্ড দখল বা উদ্ধারের লড়াই? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সংঘাতের মূল কারণ এবং বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামত বিবেচনা করতে হবে।
ভূখণ্ডের জন্য সংঘাতের দৃষ্টিকোণ: ইসরায়েলি বাহিনী ও হামাসের সহিংসতার অন্যতম কারণ ভূমির দখল এবং নিয়ন্ত্রণ। ১৯৬৭ সালের আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের পর পশ্চিম তীর এবং গাজা ভূখণ্ড দখল করে নেয় তেলআবিব, যা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ এবং ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ ৩৭ হাজার ইসরায়েলি পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাস করছে, যা আরব বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে। এই বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ফিলিস্তিনিরা এটিকে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধা হিসেবে মনে করেন।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ: যদিও এই সংঘর্ষ এবং সহিংসতার মূল কারণ ভূমি, তবে ধর্মীয় উপাদান এবং অনুভূতিও এতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
হামাসের ১৯৮৮ সালের সনদে ফিলিস্তিনকে ইসলামিক ভূমি (ভূখণ্ড) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইসরায়েলের বিলুপ্তি আহ্বান করা হয়েছে। এই সনদে উল্লেখ করা হয়েছে যে ফিলিস্তিনের ভূমি একটি ইসলামিক ওয়াকফ, যা বেচাকেনা বা অর্থের বিনিময়ে হস্তান্তর করা যায় না।
অপরদিকে, ইসরায়েলের কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডকে ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিদের পবিত্র ভূমি হিসেবে দাবি করে এবং সেখানে বসতি স্থাপনকে ধর্মীয় অধিকার মনে করে। এই ধর্মীয় বিশ্বাস এই সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে।
পেছনে ফিরে দেখা: ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের শিকড় উনিশ শতকে, যখন প্রবাসী ইহুদিরা বিভিন্ন দেশ থেকে আধুনিক ইসরায়েল অঞ্চলে ফিরে এসে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জমি কিনতে শুরু করেন, তখন থেকেই এই বিরোধের সূত্রপাত।
এদিকে, ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেম সংলগ্ন শেখ জাররাহ অঞ্চলকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দাবি করে। অন্যদিকে ইসরায়েলিরা মনে করে পুরো জেরুজালেম শহর তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকা উচিত।
মূলত, এই সংঘাত একটি পবিত্র ভূমির দখলদারিত্ব সংক্রান্ত বিরোধ। তবে অনেকের মতে, ধর্ম এবং ধর্মীয় অনুভূতি এই সংঘাতে প্রতীক বা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে দুইটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্ম একে অপরের মুখোমুখি।
অনেকে অবাক হন কেন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত প্রায়শই ধর্মীয় উৎসব ঘিরে তীব্রতর হয়ে উঠে। তবে এ কথা স্পষ্ট, হামাসের (প্রতিরোধ) যুদ্ধ ইহুদিধর্মের বিরুদ্ধে নয়, বরং ইসরায়েল যেসব ভূমি দখল করে রেখেছে, সেসব ফিলিস্তিনিদের হাতে ফিরিয়ে দিতে তাদের এই প্রতিরোধ। ইহুদিদের পক্ষ থেকে পবিত্র শহর জেরুজালেম নিয়ে একচেটিয়া দাবি অনেক সময় প্রাণঘাতী সংঘাতে রূপ নেয়।
ইহুদি, ইসলাম ও খ্রিস্টান এই তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব ধর্মের ইতিহাস খতিয়ে দেখলে জানা যায়, শান্তি ও সংঘাত পরস্পরবিরোধী দুটি অবস্থাকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে ধর্মীয় ভূমিকা অনেক সময় সাংঘর্ষিক এবং অস্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়।
ধর্মকে ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেয়া ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ইতিহাসজুড়ে বহু যুদ্ধের মূল কারণ হয়েছে। মধ্যযুগের ক্রুসেড (ইউরোপীয় খ্রিস্টান বনাম আরব মুসলিম) থেকে শুরু করে ত্রিশ বছরের যুদ্ধ (মূলত ক্যাথলিক বনাম প্রোটেস্ট্যান্ট) পর্যন্ত, যা সতের শতকে ইউরোপকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
আজকের দিনেও ধর্মীয় উপাদান ও সহিংসতা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এই প্রবণতা ইসরায়েল-হামাস সংঘাতেও প্রতিফলিত হয়েছে।
ইসরায়েলের পক্ষে অর্থডক্স (রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থি) ইহুদি ও জায়নবাদীরা (জায়নিস্ট) এবং ফিলিস্তিনি পক্ষের হামাস, উভয়েই তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংঘাতে জড়িত।
১৯৮৮ সালের হামাস সনদ, যাকে ‘দ্য কভেনেন্ট অব দ্য ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্টে (সিআইআরএম) বলা হয়। অনেকের অভিযোগ, এটিই অন্যতম প্রমাণ যে কীভাবে ধর্মকে নিজেদের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছে হামাস। এই সনদে ফিলিস্তিনকে ইসলামি ভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ইসরায়েলি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরোধিতা করা হয়। এইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাণকেন্দ্রে ধর্ম, ভূমি এবং জাতীয়তাবাদের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এক জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: সিঙ্গাপুরের চতুর্থ মুফতি এবং আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক আইনে স্নাতক ডিগ্রিধারী ড. নাজিরুদ্দিন মোহাম্মদ নাসির মনে করেন, ধর্মকে সংঘর্ষের হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার না করে শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে কাজে লাগানো উচিত। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় ইতিহাস, ধর্মগ্রন্থ এবং এর শব্দাবলিকে বিভিন্ন পক্ষ নিজের সুবিধায় বিভিন্নভাবে অপব্যবহার করেছে, যা কেবল সংঘর্ষকে উসকে দেয়। এটি পরিবর্তন করা জরুরি যাতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সুযোগ সৃষ্টি হয়। ড. নাজিরুদ্দিন মোহাম্মদ নাসির অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি সম্পন্ন করেন, যেখানে তার গবেষণার মূল বিষয় ছিল আব্রাহামিক ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ।
এদিকে, ইসরায়েলের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক এবং স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেসমেন্ট জার্নালের প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক কোবি মাইকেল মনে করেন, ‘বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েলি সরকার গত বছর হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে এবং পরিস্থিতি শান্ত করতে কিছুই করেনি।’
গাজা যুদ্ধের শুরুর দিকে বিশিষ্ট এই গবেষক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া চলছিল, সেটাই মূলত উত্তেজনা সৃষ্টির অন্যতম কারণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রক্রিয়াটি আঞ্চলিক শক্তি ইরানি নেতৃত্বের মোটেও পছন্দ ছিল না এবং তেহরানের সহযোগী গোষ্ঠী হামাসও এতে ক্ষুব্ধ ছিল। তারা যেকোনো উপায়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে, অস্থিতিশীল করতে এবং সৌদি আরবকে বিব্রত করতে চায়ছিল, যাতে সৌদি যুবরাজ এবং নেতৃত্ব এই সম্পর্কান্নয়নের পথে এগিয়ে না যায়।’
হামাস নিজেও জানিয়েছে যে, ইসরায়েলে তাদের সাম্প্রতিক হামলার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল জেরুজালেমে অবস্থিত টেম্পল মাউন্ট বা হারাম আল-শরীফকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি। এই স্থানটি ইহুদি ও মুসলমান উভয়ের কাছেই পবিত্র।
হামাস অভিযোগ করেছে, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা সম্প্রতি আল আকসা মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে প্রার্থনা করেছে, যেটিকে তারা ‘পবিত্রতার অবমাননা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। এই ঘটনায় তারা গভীরভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবরের হামলা ছিল সেই ক্ষোভেরই প্রতিক্রিয়া।
গাজা যুদ্ধ মূলত ভূখণ্ডের জন্য সংঘর্ষ হলেও ধর্মীয় উপাদান এবং অনুভূতি এতে গভীরভাবে মিশে রয়েছে। ভূমি দখল এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের মিশ্রণে এই সংঘর্ষ জটিল আকার ধারণ করেছে। এই অবস্থায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় নেতাসহ রাজনৈতিক নেতা ও সরকারপ্রধানদের মধ্যে সংলাপ এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ানো জরুরি, যাতে ধর্মকে সংঘর্ষের হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার না করে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়।